পদ্মা নদীর মাঝি (Boatman of the Padma) ঔপন্যাসিক মানিক বন্দোপাধ্যায় রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পঠিত, আলোচিত ও একাধিক বিদেশী ভাষায় অনূদিত জনপ্রিয় একটি উপন্যাস। এটি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের চতুর্থ উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৩৪ সাল থেকে পূর্বাশা পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে এবং ১৯৩৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হওয়ার পরে ভারতীয় উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভাষায় অনূদিত হওয়ার গৌরব লাভ করে এই উপন্যাসটি। ভারতের একাধিক প্রাদেশিক ভাষাসহ ইংরেজি, চেক, হাঙ্গেরিয়ান, রুশ, লিথুয়ানিয়ান, নরওয়েজিয়ান ও সুইডিশ ভাষায় এই উপন্যাসের অনুবাদ প্রকশিত হয়। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে পদ্মা নদীর মাঝি চলচ্চিত্র।
ইতিহাস:
উপন্যাসটি কলকাতা থেকে সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা মাসিক পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ ১৩৪১ থেকে শ্রাবণ ১৩৪২ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে নয় কিস্তি ছাপার পর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। এক বছর পর ১৯৩৬-এর মে মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পূর্বাশা পত্রিকায় ছাপার সময় দেবীগঞ্জ ও আমিনবাড়ির এই দুটি স্থানের নাম ছিল যথাক্রমে গোয়ালন্দ ও রাজবাড়ী।
অনুবাদ:
হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কৃত প্রথম ইংরেজি অনুবাদ (Boatman of the Padma) প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালে যথাক্রমে পদ্মা নদীর মাঝির সুইডিশ ও চেক ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া হাঙ্গেরী, জার্মান ও ডাচ ভাষায়ও উপন্যাসটির অনুবাদ হয়। বাংলাদেশে দুবার পদ্মা নদীর মাঝির চলচ্চিত্র রূপ দেওয়া হয়। ঢাকায় নতুন প্রতিষ্ঠিত এফডিসি প্রাথমিক পর্যায়ে উর্দু ভাষায় নির্মিতব্য যে ছবি করার অনুমতি দেয় তা ছিল এ জে কারদার পরিচালিত জাগো হুয়া সাভেরা (ডে শ্যাল ডন)। এই চলচ্চিত্রটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝিকে অবলম্বন করে নির্মিত হয় ১৯৫৮ সালে। কিন্তু লেখক যেহেতু হিন্দু ও ভারতীয়, তাই লেখকের নাম ব্যবহূত হয়নি। কাহিনিকার হিসেবে বিশিষ্ট উর্দু ভাষার কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের নাম উল্লেখ করা হয়। এ জন্য ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে প্রচুর সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি অবশ্য গান ও সংলাপ বলার দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে গৌতম ঘোষ ১৯৯২ সালে পদ্মা নদীর মাঝির চলচ্চিত্রে রূপ দেন।
পটভূমি:
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের বিক্রমপুর-ফরিদপুর অঞ্চল। এই উপন্যাসের দেবীগঞ্জ ও আমিনবাড়ি পদ্মার তীরবর্তী গ্রাম। উপন্যাসে পদ্মার তীর সংলগ্ন কেতুপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের পদ্মার মাঝি ও জেলেদের বিশ্বস্ত জীবনালেখ্য চিত্রিত হয়েছে। পদ্মা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী। এর ভাঙন প্রবণতা ও প্রলয়ংকরী স্বভাবের কারণে একে বলা হয় 'কীর্তিনাশা' বা রাক্ষুসী পদ্মা। এ নদীর তীরের নির্দিষ্ট কোন সীমারেখা নেই। শহর থেকে দূরে এ নদী এলাকার কয়েকটি গ্রামের দীন-দরিদ্র জেলে ও মাঝিদের জীবনচিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে। জেলেপাড়ারর মাঝি ও জেলেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-অভাব-অভিযোগ - যা কিনা প্রকৃতিগতভাবে সেই জীবনধারায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা এখানে বিশ্বস্ততার সাথে চিত্রিত হয়েছে। তাদের প্রতিটি দিন কাটে দীনহীন অসহায় আর ক্ষুধা-দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই যেন তাদের জীবনের পরম আরাধ্য। এটুকু পেলেই তারা খুশি।
উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণ:
সব কটি চরিত্রই যেন এই উপন্যাসের পটভূমি এবং সমাজের বাসিন্দাদের অকৃত্রিম রূপায়ন।আশ্চর্য এবং অদ্ভুত শৈল্পিক সৌকর্য ও পরিমিততি দিয়ে লেখক অতি যত্নসহকারে চরিত্রগুলো গড়ে তুলেছেন। এরা এ সমাজের একেবারেই খাঁটি ও অকৃত্রিম চরিত্র। তারা একান্তভাবেই যেন এই সমাজের উপযুক্ত।
কুবের: পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কুবের। কুবের এ উপন্যাসের নায়কও। সংসারের অভাব-দারিদ্র্য ও দুঃখ-বেদনাদগ্ধ কুবের এক দিকে যেমন তার সংসারের অভিভাবক, তেমনি সে চিরপঙ্গু মালার স্বামী, অন্য দিকে সে তার সন্তানদের স্নেহময় পিতা। শহর থেকে দূরে পদ্মানদীর তীরে অবস্থিত অজগ্রাম কেতুপুরের সে বাসিন্দা। পদ্মা নদীর সে এক পাকা মাঝি। সে নদীতে তার অন্যান্য সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে মাছ ধরে, বিশেষত ইলিশ মাছ ধরে সে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে।
একেবারে নিম্নবিত্ত ও নিম্নতম পর্যায়ের মানুষ কুবের। সহজ সরল হওয়ায় তাকে অনেকেই ঠকায়। তার মাঝেও আছে স্বাভাবিক দোষগুণ ও কামনা-বাসনা। তাছাড়া তার আছে একটি রোমান্টিক মন। সে তার স্ত্রী মালার বোন কপিলার প্রতি আদিম আকর্ষণ অনুভব করে। এই কুবের একসময় ঘটি ও টাকা চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জেল খাটার ভয়ে হোসেন মিয়ার কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে। এক অসংস্কৃত, আদিম ও নিষিদ্ধ ভালোবাসার প্রতি আকৃষ্ট কুবের কপিলাকে নিয়ে চিরকালের জন্য চলে যায় হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপে। পেছনে রেখে যায় তার সমস্ত অতীত জীবন আর পঙ্গু, অসহায় মালা ও তার সন্তান সন্ততিদের।
কপিলা: পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের নায়িকা কপিলা। ব্যক্তিগত পরিচয়ে সে মালার বোন, সাংসারিক পরিচয়ে সে এক জনের স্ত্রী। মালার মত সে পঙ্গু নয়। পুরুষের হৃদয়ে আদিম আবেদন সৃষ্টিকারী কপিলা কুবেরের সাথে যেন উদাসীনভাবে প্রেমের অভিনয় করে যায়। তার স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় সে বাপের বাড়িতে চলে আসে। বন্যার সময় সে কিছুদিন থাকে কেতুপুরে কুবেরে বাড়িতে।
কপিলা চতুর, চপল ও উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন এক যুবতী। তার আচরণের মধ্যে কিছুটা আদিম ও অসংস্কৃত মনেরও পরিচয় লক্ষণীয়। যা সমাজের চোখে অনেকটাই নিন্দনীয়। কপিলার সতীন মারা গেকে তার স্বামী তাকে আবার নিতে এলে কপিলা অনুগত স্ত্রীর মতো তার সাথে আবার আকুর-টাকুর চলে যায়। এতে তার সংসার ও বিষয়বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু কুবের যখন চুরির দায় এড়াতে হোসেন মিয়ার ময়নাদ্বীপে যেতে মনস্ত করে, তখন কপিলা তার অতীত জীবনের সবকিছু ফেলে সেই যাত্রায় কুবেরে চিরসাথী হয়।
হোসেন মিয়া: পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের রহস্যময় অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রধান চরিত্র হোসেন মিয়া।নোয়াখালীর এই লোকটি বহুদর্শী ও বহু অভিজ্ঞ এক ব্যক্তি। কেতুপুর এলাকায় প্রথমে তাকে দীনহীন ও কপর্দকসশূন্য এক ব্যক্তিরূপে দেখা গিয়েছিল। নোয়াখালি সন্দ্বীপ থেকে সুদূর পূর্ব-দক্ষিণে সমুদ্রের বুকে হোসেন মিয়া একটি দ্বীপের পত্তন নিয়েছিল। বিভিন্ন এলাকার দরিদ্র মানুষদের নিয়ে নানা উপকারের মধ্য দিয়ে সে সেই এলাকা থেকে লোকজন নিয়ে ময়নাদ্বীপে লোকবসতি গড়ে তুলেছিল। এই ময়না দ্বীপকে ঘিরেই হোসেন মিয়ার সব স্বপ্ন। সেখানে সে এমন একটা জনসমাজ গড়ে তুলতে চায়, যেখানে দলমত ও ধর্মমত নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ একটা মানিবীয় মূল্যবোধসসম্পন্ন সমাজ গড়ে তুলবে। মনুষ্যত্ব ও মানবতাই হবে সে সমাজের প্রধান ভিত্তি।
অন্যান্য: কুবের, কপিলা ও হোসেন মিয়া ছাড়াও আরও কয়েকটি চরিত্র এই উপন্যাসে রয়েছে। যেমন- রাসু, ধনঞ্জয়, পীতম মাঝি, মালা, গণেষ, আমিনুদ্দি, রসুল, ফাতেমা প্রভৃতি চরিত্র। এ সব চরিত্রাবলিরর সমন্বয়ে এ উপন্যাসটিতে একটি সার্থক সমাজচিত্র অঙ্কনের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ঔপন্যাসিক মানিক বন্দোপাধ্যায়।
আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে সার্থকতা: পদ্মা নদীর মাঝি বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট আঞ্চলিক উপন্যাস। অলঙ্কার শাস্ত্রে আঞ্চলিক উপন্যাসের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সে অনুসারে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, এটি একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস। উপন্যাসের আঙ্গিক গঠন, রচনাশৈলী, পাত্র-পাত্রীদের মুখে আরোপিত ভাষা, জীবনাচরণ, জীবনচর্চা এ সবই আঞ্চলিক উপন্যাসেরই পরিচয়বাহী। এ সকল কারণে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্টতার দাবিদার এবং এ উপন্যাসের জগৎ বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ এক অজানা বস্তু বলে মনে হয়। নানা কারণে উপন্যাসটি জনপ্রিয়তারর শীর্ষে আরোহণ করে। এই উপন্যাসটির জনপ্রিয়তার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশিষ্ট সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গ সাহিত্য উপন্যাসের ধারা গ্রন্থে লিখেছেন-
ইহার একটি কারণ অবশ্য বিষয়ের অভিনবত্ব - পদ্মানদীর মাঝিদের দুঃসাহসিক ও কতকটা অসাধারণ জীবনযাত্রারও আকর্ষণী শক্তি। দ্বিতীয় কারণ, পূর্ববঙ্গের সরস ও কৃত্রিমতা বিবর্জিত কথ্য ভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগ। কিন্তু উপন্যাসটির সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হইতেছে ইহা সম্পূর্ণরূপে নিম্নশ্রেণী অধ্যুষিত গ্রাম্য জীবনের চিত্রাঙ্কনে সূক্ষ্ম ও নিখুঁত পরিমিতিবোধ, ইহার সঙ্কীর্ণ পরিধির মধ্যে সনাতন মানব-প্রবৃত্তিগুলির ক্ষুদ্র সংঘাত ও মৃদু উচ্ছ্বাসের যথাযথ সীমা নির্দেশ।
জেলে অধ্যুষিত গ্রামের জীবনযাত্রাই পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটির মূল উপজীব্য। এখানকার সমস্ত কিছুই যেন পরিচালিত হয় প্রকৃতির অমোঘ নির্দেশে। পদ্মা নদীর তীরবর্তী কেতুপুর সংলগ্ন যে এলাকাটির মানুষের জীবনচিত্র এখানে অঙ্কিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে বাইরের সম্পর্ক বিবর্জিত। এই আঞ্চলিক উপন্যাসটির সার্থকতা বিষয়ে সমালোচকের এই উক্তিও সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এ উপন্যাসটির কোথাও "এই ধীবর পল্লীর জীবনযাত্রায় শিক্ষিত আভিজাত্যের মার্জিত রুচি ও উচ্চ আদর্শবাদের ছায়াপাত নাই।" এ উপন্যাসটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সমালোচক যথার্থই বলেছেন-
অধিবাসীদের ঈর্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রীতি, সমবেদনা, চক্রান্ত, দলাদলি সমস্তই বাহিরের মধ্যস্ততা ছাড়া নিজ প্রকৃতি নির্ধারিত সঙ্কীর্ণ কক্ষপথে আবর্তিত হইয়াছে। একটি সুখপাঠ্য, সার্থক ও বিশিষ্ট আঞ্চলিক উপন্যাস হিসেবে এখানেই এর সার্থকতা।রিভিউ উৎস: উইকিপিডিয়া