শঙ্খনীল কারাগারে

শঙ্খনীল কারাগার
লেখক - হুমায়ূন আহমেদ
বিভাগ - উপন্যাস
নন্দিত কথাসাহিত্যিক সদ্যপ্রয়াত ড. হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কর্মজীবন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। বাকৃবিতে শিক্ষকতা করার সময়ে তিনি শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসটি লিখেছিলেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. মো. রফিকুল হক বলেন, জননন্দিত কথাসাহিত্যিক ড. হুমায়ূন আহমেদ লেখাপড়া শেষে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ৭৪ সালের মে মাস পর্যন্ত ড. হুমায়ূন আহমেদ প্রথম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তারপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি জানান, হুমায়ূন আহমেদ বাকৃবিতে শিক্ষকতা করার সময়ই তার নামকরা উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার লিখেন।
'শঙ্খনীল কারাগার' নামটির একটি ইতিহাস আছে, তিনি তাঁর বন্ধু রফিক কায়সারকে প্রশ্ন করেছিলেন, "তুমি নতুন কোন কবিতা লিখছো?" বন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, "কবিতার নাম 'শঙ্খনীল কারাগার'"। নামটি পছন্দ হয়েছিলো হুমায়ুন আহমেদের, বন্ধুর অনুমতিক্রমে তাঁর উপন্যাসের এ নাম দিয়েছিলেন। 
ঘটনার শুরু হয়েছিল ‘কারা কানন’ নামের এক প্রকাণ্ড বাড়ী থেকে। সেই বাড়ীর শিরিন সুলতানা নামক উনিশ বছর বয়সী মেয়ে যে কিনা রোজ সকালে ছাদে উঠে হারমোনিয়ামে গলা সাধতেন। সেই ছাদের চিলেকোঠায় আশ্রিত হিসেবে থাকতেন বি.এ. পাস করে চাকরির খোঁজ করতে থাকা গ্রামের এক ছেলে, নাম আজহার হোসেন। মনে মনে পছন্দ করতেন শিরিন সুলতানা নামের মেয়েটিকে। হয়ত আজহার হোসেন মনে মনে শিরিন সুলতানা কে অনেক ভালবাসতেন এবং তাকে নিজের করে চাইতেন বলেই একদিন তিনি পেয়ে যান উনার স্বপ্ন-কন্যাকে। 
দরিদ্র আজহার দেড়’শ টাকা ভাড়ার এক বাসায় তাঁর সংসার শুরু করেন— স্ত্রী এবং এক কন্যা সন্তানকে নিয়ে! এই কন্যা সন্তানটি শিরিন সুলতানার আগের সংসারের। কোন এক অজ্ঞাত কারনে তাঁর আগের সংসারটা ভেঙ্গে যায়, তাঁর আগের স্বামীর নাম ছিল আবিদ হোসেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের এক মেয়ে সব ছেড়ে ছুড়ে সংসার করতে থাকেন এক দরিদ্র ছেলের সাথে। তার অতীত বলতে কেবল ঐ কন্যা সন্তানটি, যার নাম রাবেয়া। 
এরপরে একে একে তাদের সংসারে আসে তাদের বড় ছেলে খোকা, তারপর রুনু, ঝুনু, মন্টু এবং সর্বশেষ নিনু। নিনু হওয়ার সময় তেইশ বছরের সংসার জীবনের সমাপ্তি করে মারা যান শিরিন সুলতানা। এই তেইশ বছরে তিনি কখনো একবারের জন্যেও তার বাবার বাড়িতে যান নি, গান ভালবাসা মানুষটি ভুল করেও আর কখনো গান করেন নি, ভালবাসতে পারেন নি নিজের স্বামী সন্তানকে। প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদের পাওয়া ব্যাথা আর স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার জন্যই হবে হয়তো— শিরিন সুলতানা কখনো আর স্বাভাবিক হতে পারেন নি, নিজের চারপাশে তৈরী করে রেখেছিলেন এক অদৃশ্য দেয়াল।
আজহার হোসেনও অনেকটা থেকেও নেই এই ধরনের মানুষ। সবসময় কি এক হিনমন্যতায় ভোগেন, খুব চুপচাপ স্বভাবের মানুষ তিনি। শিরিন সুলতানা মারা যাবার পর তিনি খোলস থেকে বেড়িয়ে এসে এক হাসি খুশি মানুষে পরিণত হন। সম্ভবত তাঁর ধারনা ছিল তিনি শিরিন সুলতানার স্বামী হওয়ার যোগ্য নন। উচ্চবংশের এমএ পড়া গান জানা একটা মেয়ের স্বামী হওয়ার যোগ্যতা সত্যিই তার ছিল না। সেকারণেই তিনিও নিজেকে সবকিছু থেকে চিরকাল আড়াল করে এসেছেন।
উনাদের বড় ছেলে, যার ডাকনাম খোকা, তার জবানিতেই সমগ্র উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। সে কলেজের প্রফেসর। মনে মনে কিটকি নামের তার এক খালাতো বোনকে ভালবাসত, কিন্তু কখনো ব্যাপারটা প্রকাশ পায় নি। তার ধারনা ছিল কিটকি মেয়েটাও তাকে ভালবাসে। সেই কিটকির অন্য এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায়! নিজের মনের কষ্টটা সে কাউকে বুঝতে দেয় নি। মায়ের ভালবাসা ব্যাপারটা কখনোই অনুভব করার সুযোগ হয় নি তার, এটা অবশ্য তাদের সব ভাই বোনের ক্ষেত্রেই সত্য। এই জন্যে তার মনে এক গভীর বেদনা ছিল। নিজের কথা আর সবার মত সেও লুকিয়ে রাখে। তার কাছের বন্ধু বলতে বড় বোন রাবেয়া। রাবেয়ারও কাছের বন্ধু সে। 
বিয়ের বয়স পার হলেও বিয়ে হয় নি রাবেয়ার, আর যে বিয়ে হবে না সেটাও সবাই ভালভাবেই জানে। সেকারণেই তার আগেই ছোট বোন রুনুর বিয়ের কথা ওঠে। রুনুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল মনসুরের সাথে। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির জন্য সেই বিয়েটা আর হয় না। বিয়েটা হয় ঝুনুর সাথে। সেই থেকে বদলে যেতে থাকে রুনু। বুক ভরা কষ্ট নিয়েই একসময় মৃত্যু হয় রুনু’র। কেউ বুঝতে পেরেছিল না সে দিনদিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। 
সংসারের মধ্যে মন্টু একেবারেই ভিন্ন প্রকিতির ছেলে, এক আলাদা দুনিয়ার মানুষ। সে লেখালেখি করে, পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা হয়, এমনকি তার দুইটা বইও বের হয়েছে। নিজের দুনিয়া নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে।
ছোট্ট নিনুও নিজের এক দুনিয়ায় নিজের মত করে বেড়ে উঠছে, নিজের একটা আলাদা জগৎ ধীরে ধীরে তৈরী হতে থাকে।
রাবেয়াও একসময় আবার নতুন করে কলেজে ভর্তি হয়, পড়াশুনা করে চাকরি নেয় বাড়ি থেকে দূরের এক স্কুলে। কলেজে থাকতে পড়াশুনা বাদ দিয়েছিল সে। কালো চেহারার জন্য ছেলেরা তাকে মা কালী বলেছিল— সে দুঃখে সে আর কলেজে যায় নি। তার বাবা তার মেয়ের মনের কষ্ট দূর করার জন্য ফর্সা করার ক্রীম sevenday beauty programme এনে দেন, যেটা ছিল রাবেয়ার কাছে প্রচণ্ড মূল্যবান— বিশ টাকায় কেনা এক কৌটা ভালবাসা। কিন্তু সে জানে ইনি তার জন্মদাতা বাবা না! মাত্র এগারো বছর বয়স থেকে সে এই করুণ সত্যটা জানে। বুকে কষ্ট চেপে রেখেছে চিরকাল, কাউকে সেই কষ্টের কথা কখনো বলে নি সে। 
তবে এক হৃদয়স্পর্শী চিঠির মাধ্যমে রাবেয়া বহুদিনের বহু কষ্টের কথা লিখে জানায় তার সবচেয়ে আদরের ভাই এবং কাছের মানুষ খোকাকে। সে চিঠিতে থাকে তার নিজের অতীত ইতিহাস, মায়ের কথা, বাবার কথা, আবিদ হোসেনের কথা, রুনু, ঝুনু, মন্টু, নিনু আর খোকার কথা। 
একই পরিবারের এতগুলো মানুষ কাছাকাছি থেকেও কেউ কখনো বুঝতে পারে না কার মনে কি চলছে? কারণ প্রতিটি মানুষই তার নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করে রাখে। এই যে প্রতিটি মানুষ নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করে রাখে, যে দেয়ালের মধ্যে কখনো কেউ প্রবেশ করতে পারে না, যে দেয়ালের ভেতরের কথা গুলো কখনো কেউ জানতে পারে না— এই অদৃশ্য দেয়ালের নামই ‘শঙ্খনীল কারাগার’।
এই উপন্যাস টি হুমায়ূন আহমেদ ফুটিয়ে তুলেছিলেন শুধুমাত্র তাঁর অসামান্য চিন্তাশক্তি ও প্রতিভার মধ্য দিয়ে, কোনরকম লেখকীয় দক্ষতা দিয়ে নয়। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ নবীন ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের এক অসামান্য একটি লেখা! 
পুরো বইটা পড়া হয়ে গেলেও মাথার ভেতর দুটি লাইন ঘোরাফেরা করে, যে লাইন দুটি একদম আমাদের কথা বলে; চুপচাপ মুখ বুঁজে হাসিমুখে কাজ করে যাওয়া মানুষটার ভেতরেও যে বিশাল এক অব্যক্ত চাহিদা পরে থাকে, সেই চাহিদার কথা; ভালবাসা না পেতে পেতে মনের মধ্যে সীমাহীন ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যে হাহাকার, সেই হাহাকারের কথাই যেন বলে এই দুটো লাইন—
‘দিতে পারো একশো ফানুস এনে?
আজন্ম সলজ্জ সাধ— একদিন আকাশে কিছু ফানুস ওড়াই!’
রিভিউ: দীপক
+