নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জার্মান লেখক হেরমান হেস। গৌতমবুদ্ধের অপর নাম সিদ্ধার্থ। কিন্তু হেরমান হেস রচিত সিদ্ধাৰ্থ গ্রন্থের নায়ক সিদ্ধাৰ্থ আর গৌতম বুদ্ধ দুটি ভিন্ন মানুষ। সিদ্ধাৰ্থ গ্রন্থ সম্পর্কে মার্কিন লেখক হেনরি মিলার বলেছেন: ‘সাধারণভাবে পরিজ্ঞাত বুদ্ধকে অতিক্রম করে এখানে নতুন এক বুদ্ধ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এ সাফল্য অভাবিতপূর্ব।’
হেরমান হেস সিদ্ধাৰ্থ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন: ‘Siddhartha is the expression of my liberation from Indian thinking. The Pathway of my liberation from all dogma leads upto Siddartha and will naturally continue as long as I live.
সিদ্ধাৰ্থ জ্ঞানপিপাসায় সংসার ত্যাগ করলেন, বুদ্ধের সাথে দেখা করলেন। কিন্তু তাঁর বন্ধু গোবিন্দ গৌতমবুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেও তিনি করলেন না। কারণ তিনি তথাকথিত জ্ঞান অর্জন, উপদেশ ও ধর্মের বাঁধনে বাঁধা পড়েননি। বরং প্রকৃতি থেকে নিজে নিজে শিক্ষা গ্ৰহণ করেছেন; যেমন বাসুদেব নিয়েছেন নদী থেকে, প্রকৃতি থেকে! নৌকার মাঝি হয়ে বহু লোককে নদী পারাপার করেছেন। তাঁর দীক্ষাই শেষপর্যন্ত গ্রহণ করলেন হেরমান হোসের সিদ্ধাৰ্থ গ্রন্থের নায়ক সিদ্ধার্থ।
গোবিন্দ প্রথমে বন্ধু সিদ্ধার্থকে চিনতেই পারেনি। সিদ্ধাৰ্থ কিন্তু তাকে ঠিকই চিনেছে। গোবিন্দ সিদ্ধার্থকে ষষ্ঠাঙ্গে প্ৰণাম করে ভাবছে: ‘কী বিচিত্র মানুষ সিদ্ধাৰ্থ, কী অদ্ভুত তার মতামত..। ভগবান বুদ্ধের শিক্ষার সাথে কত গভীর পার্থক্য। তিনি শিখিয়েছেন দয়া, ক্ষমা, করুণা ও ধৈর্য, কিন্তু শেখাননি প্রেম। পার্থিব প্রেমে জড়িয়ে না পড়তে তিনি আমাদের উপদেশ দিয়েছেন।’
সিদ্ধার্থের বক্তব্য সুস্পষ্ট। তিনি তাঁর বন্ধু গোবিন্দকে বিদায়বেলায় বলছেন: ‘আমার মতবাদ শুনে তুমি হয়তো হাসবে। গোবিন্দ, আমার মনে হয় ভালোবাসা সংসারের সবচেয়ে বড় জিনিস। বড় বড় দার্শনিকরা পৃথিবীকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে পারেন, সংসার-কর্মকাণ্ডের চমৎকার ব্যাখ্যা দিতে পারেন, ত্রিশটি বিচ্যূতির জন্য পৃথিবীকে ঘৃণাও করতে পারেন, কিন্তু আমাদের পক্ষে সবচেয়ে বড় কথা, এই পৃথিবীকে ভালোবাসা, তাকে ঘৃণা করা নয়। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসব, এখানকার প্রত্যেকটি প্রাণী ও বস্তুকে ভালোবাসাব, সম্মান করব, শ্ৰদ্ধা করব এই সৃষ্টির সাথে এক হয়ে।’
সিদ্ধার্থের উপরোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে জার্মান লেখক হেরমান হেসের মনের কথা ব্যক্ত হয়েছে, ব্যক্ত হয়েছে তাঁর নিজস্ব দর্শন। অর্থাৎ প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। ভালোবাসাই মানুষকে পথের সন্ধান দেয়, সারাজীবন যে পথের সন্ধানে সে ঘুরে বেড়ায়।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে আমার অনূদিত সিদ্ধাৰ্থ গ্রন্থ প্রকাশের ব্যাপারে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সাহায্যের জন্য বিশিষ্ট কবি ও ভাষাবিদ অনুজপ্রতিম সাযযাদ কান্দিরের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এ প্রসঙ্গে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্ণধার, আমাদের সকলের প্রিয়, বন্ধুবর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কথা উল্লেখ করতে দ্বিধা নেই। তারই অনুপ্রেরণায় সিদ্ধাৰ্থ বইটি দ্রুত প্রকাশিত হয়ে পাঠকদের কাছে পৌছোচ্ছে।
তাছাড়া সিদ্ধাৰ্থ ছাপা, কভার ডিজাইন, প্রুফ রিডিং থেকে শুরু করে বাঁধাই সবকিছুর ব্যাপারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রকাশনা বিভাগের সুপ্রিয় হুমায়ুন কবির। বইটি প্রকাশের ব্যাপারে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সমন্বয়কারী গোলাম কিবরিয়া সর্বপ্রথম আমার সাথে যোগাযোগ করেন। তার উৎসাহ ও সহমর্মিতা আমাকে বিশেষভাবে অভিভূত করেছে। এঁদের দুজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে খাটো করতে চাই না।
অনুদিত অন্যান্য গ্রন্থের ন্যায় সিদ্ধাৰ্থ পাঠকমহলে আদৃত হবে এই বিশ্বাস আমার আছে।
জাফর আলম
মীরপুর-৬, ঢাকা-১২১৬