মিসির আলি অমনিবাস ৩
মিসির আলি অমনিবাস ৩
লেখক - হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি, বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় রহস্যময় চরিত্র। মিসির আলী কাহিনীগুলো রহস্যমাত্রিক। মিসির আলির কাহিনীগুলো ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী নয়, কিংবা 'ক্রাইম ফিকশন' বা 'থ্রিলার'-এর মতো খুনি-পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক, বিজ্ঞাননির্ভর এবং প্রচন্ড যুক্তিনির্ভর কাহিনীর বুনটে বাঁধা। বরং অনেক ক্ষেত্রে একে রহস্যগল্প বলা চলে। চারিত্রিক দিক দিয়ে মিসির আলি চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি হিমু চরিত্রটির পুরোপুরি বিপরীত। তরুণ হিমু চলে প্রতি-যুক্তির (anti-logic) তাড়নায়; অপরপক্ষে বয়োজ্যেষ্ঠ মিসির আলি অনুসরণ করেন বিশুদ্ধ যুক্তি (pure logic)। এই যুক্তিই মিসির আলিকে রহস্যময় জগতের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে সাহায্য করে। সেসব কাহিনীর প্রতিফলন ঘটেছে মিসির আলি সম্পর্কিত প্রতিটি উপন্যাসে।
মিসির আলি অমনিবাস ২
মিসির আলি অমনিবাস ২
লেখক - হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি, বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় রহস্যময় চরিত্র। মিসির আলী কাহিনীগুলো রহস্যমাত্রিক। মিসির আলির কাহিনীগুলো ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী নয়, কিংবা 'ক্রাইম ফিকশন' বা 'থ্রিলার'-এর মতো খুনি-পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক, বিজ্ঞাননির্ভর এবং প্রচন্ড যুক্তিনির্ভর কাহিনীর বুনটে বাঁধা। বরং অনেক ক্ষেত্রে একে রহস্যগল্প বলা চলে। চারিত্রিক দিক দিয়ে মিসির আলি চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি হিমু চরিত্রটির পুরোপুরি বিপরীত। তরুণ হিমু চলে প্রতি-যুক্তির (anti-logic) তাড়নায়; অপরপক্ষে বয়োজ্যেষ্ঠ মিসির আলি অনুসরণ করেন বিশুদ্ধ যুক্তি (pure logic)। এই যুক্তিই মিসির আলিকে রহস্যময় জগতের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে সাহায্য করে। সেসব কাহিনীর প্রতিফলন ঘটেছে মিসির আলি সম্পর্কিত প্রতিটি উপন্যাসে।
ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলি চরিত্রটির ধারণা প্রথম পেয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে, স্ত্রীর সাথে গাড়িতে ভ্রমণের সময়। চরিত্রটির ধারণা মাথায় চলে এলেও তিনি মিসির আলি চরিত্রের প্রথম উপন্যাস "দেবী" লিখেন এই ঘটনার অনেকদিন পর।
উপন্যাসের কাহিনী অনুসারে মিসির আলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের "মনোবিজ্ঞান" (Psychology) বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক (খন্ডকালীন)। শুধুমাত্র একজন শিক্ষক হিসেবেই নন, তাঁর অনুসারীদের কাছেও তিনি বেশ মর্যাদাবান একজন চরিত্র হিসেবে উল্লিখিত। সেজন্য উপন্যাস বা বড় গল্পে, মিসির আলিকে বোঝাতে লেখক 'তার' লেখার পরিবর্তে সম্মানসূচক 'তাঁর' শব্দটির ব্যবহার করতেন। মিসির আলির বয়স ৪০-৫০-এর মধ্যে। তাঁর মুখ লম্বাটে। সেই লম্বাটে মুখে এলোমেলো দাড়ি, লম্বা উসখো-খুসকো কাঁচা পাকা চুল। প্রথম দেখায় তাঁকে ভবঘূরে বলে মনে হতে পারে; কিছুটা আত্মভোলা। তাঁর হাসি খুব সুন্দর, শিশুসুলভ। মিসির আলির স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো।
তিনি মানুষের মন, আচরণ, স্বপ্ন এবং নানাবিধ রহস্যময় ঘটনা নিয়ে অসীম আগ্রহ রাখেন। হুমায়ুন আহমেদের নিজের ভাষ্যে—
মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা।
চরিত্রটির পরিচিতি দিতে গিয়ে হুমায়ুন আহমেদ বলছেন—
মিসির আলি একজন মানুষ, যাঁর কাছে প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলা বড় কথা, রহস্যময়তার অস্পষ্ট জগৎ যিনি স্বীকার করেন না।
মিসির আলি চরিত্রে হুমায়ুন আহমেদ, পরস্পর বিপরীতধর্মী দুটি বৈশিষ্ট্য 'যুক্তি' এবং 'আবেগ'কে স্থান দিয়েছেন।
মিসির আলি একজন ধূমপায়ী। তিনি 'ফিফটি ফাইভ' ব্র্যান্ডের সিগারেট খান। তবে তিনি প্রায়ই সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করেন। তাঁর শরীর বেশ রোগাটে আর রোগাক্রান্ত। নানারকম রোগে তাঁর শরীর জর্জরিত: লিভার বা যকৃৎ প্রায় পুরোটাই অকেজোঁ প্রায়, অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে, রক্তের উপাদানে গড়বড়, হৃৎপিণ্ড ড্রপ বিট দেয়। এজন্য কঠিন এসব রোগের পাশাপাশি সাধারণ যেকোনো রোগই তাঁকে বেশ কাহিল করে ফেলে। ফলে প্রায়ই অসম্ভব রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন।
মিসির আলি যুক্তিনির্ভর একজন মানুষ বলেই অসম সাহসিক। ভূতাশ্রিত স্থানেও রাত কাটাতে তিনি পিছপা হোন না, বরং এজন্য থাকেন যে, তাতে তিনি রহস্যময়তার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারবেন। মিসির আলির অনেকগুলো পারঙ্গমতার মধ্যে অন্যতম হলো তিনি যে কাউকে, বিশেষ করে ঠিকানাওয়ালা মানুষকে, খুব সহজে অজানা স্থানেও খুঁজে বের করতে পারেন। এজন্য তিনি টেলিফোন ডিরেক্টরি, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর, টিভি-বেতার-এর লাইসেন্স নম্বর, পুলিশ কেস রিপোর্ট, হাসপাতালের মর্গের সুরতহাল (পোস্টমোর্টেম) রিপোর্ট ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। মিসির আলি প্রকৃতির বিষ্ময়ে বিষ্মিত হলেও প্রচণ্ড যুক্তির বলে বিশ্বাস করেন প্রকৃতিতে রহস্য বলে কিছু নেই। মিসির আলি ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে একজন নাস্তিক। মিসির আলি সিরিজের প্রথম উপন্যাস "দেবী"-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি নিজেকে নাস্তিক বলে অভিহিত করেছেন। তবে কিছু জায়গায় তাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী অর্থাৎ একজন আস্তিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
মিসির আলি মূলত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ, মোটামুটি সব উপন্যাসে তাঁকে এভাবেই রূপায়িত করা হয়। কিন্তু "অন্য ভূবন" উপন্যাসে মিসির আলি বিয়ে করে ফেলেন বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু পরবর্তী উপন্যাসগুলিতে আবার তাঁকে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এপ্রসঙ্গে লেখক নিজেই স্বীকার করেন যে, "এটি বড় ধরণের ভুল" ছিলো। মিসির আলির মতো চরিত্র বিবাহিত পুরুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেই ভুল শুধরে পরবর্তি উপন্যাসগুলোতে আবার মিসির আলিকে নিঃসঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করেন লেখক। ফলে মিসির আলি চরিত্রটি যা দাঁড়ায়: মিসির আলি ভালোবাসার গভীর সমুদ্র হৃদয়ে লালন করেন, কিন্তু সেই ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেবার মতো কাউকেই কখনও কাছে পান না। ভালোবাসার একাকীত্বে জর্জরিত মিসির আলির নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে বিভিন্ন সময় কিশোরবয়সী কাজের লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন: "আমি এবং আমরা" উপন্যাসে "বদু" নামের একটি, ১৫-১৬ বছরের কাজের ছেলের উল্লেখ রয়েছে। 'দেবী' ও 'নিশীথিনী' গল্পে হানিফা নামে একটা কাজের মেয়ে ছিল। এরকম কাজের লোককে মিসির আলি লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেন। আবার "অন্য ভূবন" উপন্যাসে "রেবা" নামের একটি কাজের মেয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মিসির আলির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত সারমর্ম করতে হুমায়ূন আহমেদই লিখেন—মিসির আলি নিঃসঙ্গ, হৃদয়বান, তীক্ষ্ণ ধীশক্তির অধিকারী। কাহিনী অনুসারে তিনি অকৃতদার। চরিত্রটি লেখকেরও, প্রিয় চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মিসির আলি চরিত্রটি এতোটাই পাঠক জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে, অনেকেই তাঁকে রক্তমাংসের মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ প্রায়ই জিজ্ঞাসিত হন যে, মিসির আলি কি কোনো বাস্তব চরিত্রকে দেখে লেখা কিনা। এর নেতিবাচক উত্তর পেয়ে অনেকেই আবার মিসির আলি চরিত্রটির মধ্যে লেখকেরই ছায়া খুঁজে পান। এপ্রসঙ্গে স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদই উত্তর করেন—
না, মিসির আলিকে আমি দেখিনি। অনেকে মনে করেন লেখক নিজেই হয়তো মিসির আলি। তাঁদেরকে বিনীতভাবে জানাচ্ছি- আমি মিসির আলি নই। আমি যুক্তির প্রাসাদ তৈরি করতে পারি না এবং আমি কখনও মিসির আলির মতো মনে করিনা প্রকৃতিতে কোনো রহস্য নেই। আমার কাছে সব সময় প্রকৃতিকে অসীম রহস্যময় বলে মনে হয়।
কিন্তু এই অভয়বাণীসত্ত্বেয় নলিনী বাবু B.Sc উপন্যাসে লেখককেই মিসির আলীর ভূমিকায় দেখা যায়, এবং তিনি যে মিসির আলী থেকে আলাদা কিন্তু তাঁর স্রষ্টা তার স্পষ্ট উল্লেখ করেন—
আমি (লেখক) এই ভেবে আনন্দ পেলাম যে, সালেহ চৌধুরী (লেখকের সফরসঙ্গী) মিসির আলিকে উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে দেখছেন না। অতি বুদ্ধিমান মানুষও মাঝে মাঝে বাস্তব-অবাস্তব সীমারেখা মনে রাখতে পারেন না।
হুমায়ূন আহমেদের এই জনপ্রিয় চরিত্রটিকে বিটিভির পর্দায় বেশ কয়েকবার নিয়ে আসা হয়েছে। অনেক খ্যাতিমান টিভি অভিনেতা অভিনেত্রীরা মিসির আলির উপন্যাস-কেন্দ্রিক নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে অধিকাংশ নাটকে মিসির আলির চরিত্র রূপায়ণে ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যাভিনেতা আবুল হায়াত। এছাড়া প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের একবার এই চরিত্রে রূপদান করেছেন।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে, এনটিভিতে সর্বপ্রথম, মিসির আলিকে নিয়ে একটি নাটক তৈরি হয়। নাটকটি তৈরি করেছিলেন নির্মাতা অনিমেষ আইচ। নাটকটির নাম ছিলো "বৃহন্নলা", যা ছিলো, মিসির আলি-কেন্দ্রিক উপন্যাস "বৃহন্নলা"র নাট্যরূপ। নাটকটিতে মিসির আলি'র ভূমিকায় অভিনয় করেন, তরুণ অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুত। পরবর্তিতে অনিমেশ আইচ, মিসির আলির, "নিষাদ" উপন্যাসটিকে নিয়ে "নিষাদ" নামে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন, যা ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে এনটিভিতে প্রচারিত হয়েছিলো। 'নিষাদ'-এ মিসির আলির চরিত্রে অভিনয় করেন প্রখ্যাত অভিনেতা শাহরিয়ার শূভ।
মিসির আলি সংক্রান্ত উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ প্রথম পর্যায়ে আলাদা আলাদা বই আকারে বের হলেও পরবর্তিতে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা চরিত্রটির পাঠক সমাদর বিবেচনা করে তা সংকলিত আকারেও প্রকাশ করে। এরকম সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রতীক প্রকাশনা সংস্থার "মিসির আলি অমনিবাস ১" ও "মিসির আলি অমনিবাস ২"। এছাড়াও মিসির আলির সমস্ত উপন্যাস নিয়ে (মিসির আলি আনসল্ভড, "মিসির আলি, আপনি কোথায়?", "পুফি" এবং "যখন নামিবে আঁধার" ব্যতীত) অনন্যা প্রকাশনা সংস্থা মিসির আলি সমগ্র নামে একটি বই প্রকাশ করে। বইটি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয়। কলকাতার কাকলি প্রকাশনী দুই খণ্ডে সম্প্রতি মিশির আলি সমগ্র প্রকাশ করেছে।
মিসির আলি অমনিবাস ২
এই খণ্ডে রয়েছে
- আমি এবং আমরা
- তন্দ্রাবিলাস
- হিমুর দ্বিতীয় প্রহর
- আমিই মিসির আলি
- বাঘবন্দি মিসির আলি
- কহেন কবি কালিদাস
লেখক হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার কেন্দুয়ার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তিনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হিসেবে পরিচিত। 'নন্দিত নরকে' উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথেই তিনি বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়েন। এরপর তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস 'শঙ্খনীল কারাগার' প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। এরপর তাঁর লেখনি আর থামেনি। তিনি সৃষ্টি করেছেন বাংলা উপন্যাসের জনপ্রিয় চরিত্র 'হিমু' ও 'মিসির আলি'কে। নাটক ও সিনেমা তৈরিতেও তাঁর সফলতা রয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর অসংখ্য বহুমাত্রিক সৃষ্টির জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হলোঃ বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), শিশু একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক (১৯৯৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসুদন পদক (১৯৮৭), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই-এ স্থানীয় সময় ১১:২০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হসপিটালে এই নন্দিত লেখক মৃত্যুবরণ করেন। তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়।
শঙ্খনীল কারাগারে
শঙ্খনীল কারাগার
লেখক - হুমায়ূন আহমেদ
বিভাগ - উপন্যাস
নন্দিত কথাসাহিত্যিক সদ্যপ্রয়াত ড. হুমায়ূন আহমেদের প্রথম কর্মজীবন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) রসায়ন বিভাগে শিক্ষকতার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। বাকৃবিতে শিক্ষকতা করার সময়ে তিনি শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসটি লিখেছিলেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. মো. রফিকুল হক বলেন, জননন্দিত কথাসাহিত্যিক ড. হুমায়ূন আহমেদ লেখাপড়া শেষে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ৭৪ সালের মে মাস পর্যন্ত ড. হুমায়ূন আহমেদ প্রথম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। তারপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি জানান, হুমায়ূন আহমেদ বাকৃবিতে শিক্ষকতা করার সময়ই তার নামকরা উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার লিখেন।
'শঙ্খনীল কারাগার' নামটির একটি ইতিহাস আছে, তিনি তাঁর বন্ধু রফিক কায়সারকে প্রশ্ন করেছিলেন, "তুমি নতুন কোন কবিতা লিখছো?" বন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন, "কবিতার নাম 'শঙ্খনীল কারাগার'"। নামটি পছন্দ হয়েছিলো হুমায়ুন আহমেদের, বন্ধুর অনুমতিক্রমে তাঁর উপন্যাসের এ নাম দিয়েছিলেন।
ঘটনার শুরু হয়েছিল ‘কারা কানন’ নামের এক প্রকাণ্ড বাড়ী থেকে। সেই বাড়ীর শিরিন সুলতানা নামক উনিশ বছর বয়সী মেয়ে যে কিনা রোজ সকালে ছাদে উঠে হারমোনিয়ামে গলা সাধতেন। সেই ছাদের চিলেকোঠায় আশ্রিত হিসেবে থাকতেন বি.এ. পাস করে চাকরির খোঁজ করতে থাকা গ্রামের এক ছেলে, নাম আজহার হোসেন। মনে মনে পছন্দ করতেন শিরিন সুলতানা নামের মেয়েটিকে। হয়ত আজহার হোসেন মনে মনে শিরিন সুলতানা কে অনেক ভালবাসতেন এবং তাকে নিজের করে চাইতেন বলেই একদিন তিনি পেয়ে যান উনার স্বপ্ন-কন্যাকে।
দরিদ্র আজহার দেড়’শ টাকা ভাড়ার এক বাসায় তাঁর সংসার শুরু করেন— স্ত্রী এবং এক কন্যা সন্তানকে নিয়ে! এই কন্যা সন্তানটি শিরিন সুলতানার আগের সংসারের। কোন এক অজ্ঞাত কারনে তাঁর আগের সংসারটা ভেঙ্গে যায়, তাঁর আগের স্বামীর নাম ছিল আবিদ হোসেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের এক মেয়ে সব ছেড়ে ছুড়ে সংসার করতে থাকেন এক দরিদ্র ছেলের সাথে। তার অতীত বলতে কেবল ঐ কন্যা সন্তানটি, যার নাম রাবেয়া।
এরপরে একে একে তাদের সংসারে আসে তাদের বড় ছেলে খোকা, তারপর রুনু, ঝুনু, মন্টু এবং সর্বশেষ নিনু। নিনু হওয়ার সময় তেইশ বছরের সংসার জীবনের সমাপ্তি করে মারা যান শিরিন সুলতানা। এই তেইশ বছরে তিনি কখনো একবারের জন্যেও তার বাবার বাড়িতে যান নি, গান ভালবাসা মানুষটি ভুল করেও আর কখনো গান করেন নি, ভালবাসতে পারেন নি নিজের স্বামী সন্তানকে। প্রথম বিবাহ বিচ্ছেদের পাওয়া ব্যাথা আর স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার জন্যই হবে হয়তো— শিরিন সুলতানা কখনো আর স্বাভাবিক হতে পারেন নি, নিজের চারপাশে তৈরী করে রেখেছিলেন এক অদৃশ্য দেয়াল।
আজহার হোসেনও অনেকটা থেকেও নেই এই ধরনের মানুষ। সবসময় কি এক হিনমন্যতায় ভোগেন, খুব চুপচাপ স্বভাবের মানুষ তিনি। শিরিন সুলতানা মারা যাবার পর তিনি খোলস থেকে বেড়িয়ে এসে এক হাসি খুশি মানুষে পরিণত হন। সম্ভবত তাঁর ধারনা ছিল তিনি শিরিন সুলতানার স্বামী হওয়ার যোগ্য নন। উচ্চবংশের এমএ পড়া গান জানা একটা মেয়ের স্বামী হওয়ার যোগ্যতা সত্যিই তার ছিল না। সেকারণেই তিনিও নিজেকে সবকিছু থেকে চিরকাল আড়াল করে এসেছেন।
উনাদের বড় ছেলে, যার ডাকনাম খোকা, তার জবানিতেই সমগ্র উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। সে কলেজের প্রফেসর। মনে মনে কিটকি নামের তার এক খালাতো বোনকে ভালবাসত, কিন্তু কখনো ব্যাপারটা প্রকাশ পায় নি। তার ধারনা ছিল কিটকি মেয়েটাও তাকে ভালবাসে। সেই কিটকির অন্য এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায়! নিজের মনের কষ্টটা সে কাউকে বুঝতে দেয় নি। মায়ের ভালবাসা ব্যাপারটা কখনোই অনুভব করার সুযোগ হয় নি তার, এটা অবশ্য তাদের সব ভাই বোনের ক্ষেত্রেই সত্য। এই জন্যে তার মনে এক গভীর বেদনা ছিল। নিজের কথা আর সবার মত সেও লুকিয়ে রাখে। তার কাছের বন্ধু বলতে বড় বোন রাবেয়া। রাবেয়ারও কাছের বন্ধু সে।
বিয়ের বয়স পার হলেও বিয়ে হয় নি রাবেয়ার, আর যে বিয়ে হবে না সেটাও সবাই ভালভাবেই জানে। সেকারণেই তার আগেই ছোট বোন রুনুর বিয়ের কথা ওঠে। রুনুর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল মনসুরের সাথে। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝির জন্য সেই বিয়েটা আর হয় না। বিয়েটা হয় ঝুনুর সাথে। সেই থেকে বদলে যেতে থাকে রুনু। বুক ভরা কষ্ট নিয়েই একসময় মৃত্যু হয় রুনু’র। কেউ বুঝতে পেরেছিল না সে দিনদিন শেষ হয়ে যাচ্ছে।
সংসারের মধ্যে মন্টু একেবারেই ভিন্ন প্রকিতির ছেলে, এক আলাদা দুনিয়ার মানুষ। সে লেখালেখি করে, পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা হয়, এমনকি তার দুইটা বইও বের হয়েছে। নিজের দুনিয়া নিয়ে সে ব্যস্ত থাকে।
ছোট্ট নিনুও নিজের এক দুনিয়ায় নিজের মত করে বেড়ে উঠছে, নিজের একটা আলাদা জগৎ ধীরে ধীরে তৈরী হতে থাকে।
রাবেয়াও একসময় আবার নতুন করে কলেজে ভর্তি হয়, পড়াশুনা করে চাকরি নেয় বাড়ি থেকে দূরের এক স্কুলে। কলেজে থাকতে পড়াশুনা বাদ দিয়েছিল সে। কালো চেহারার জন্য ছেলেরা তাকে মা কালী বলেছিল— সে দুঃখে সে আর কলেজে যায় নি। তার বাবা তার মেয়ের মনের কষ্ট দূর করার জন্য ফর্সা করার ক্রীম sevenday beauty programme এনে দেন, যেটা ছিল রাবেয়ার কাছে প্রচণ্ড মূল্যবান— বিশ টাকায় কেনা এক কৌটা ভালবাসা। কিন্তু সে জানে ইনি তার জন্মদাতা বাবা না! মাত্র এগারো বছর বয়স থেকে সে এই করুণ সত্যটা জানে। বুকে কষ্ট চেপে রেখেছে চিরকাল, কাউকে সেই কষ্টের কথা কখনো বলে নি সে।
তবে এক হৃদয়স্পর্শী চিঠির মাধ্যমে রাবেয়া বহুদিনের বহু কষ্টের কথা লিখে জানায় তার সবচেয়ে আদরের ভাই এবং কাছের মানুষ খোকাকে। সে চিঠিতে থাকে তার নিজের অতীত ইতিহাস, মায়ের কথা, বাবার কথা, আবিদ হোসেনের কথা, রুনু, ঝুনু, মন্টু, নিনু আর খোকার কথা।
একই পরিবারের এতগুলো মানুষ কাছাকাছি থেকেও কেউ কখনো বুঝতে পারে না কার মনে কি চলছে? কারণ প্রতিটি মানুষই তার নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করে রাখে। এই যে প্রতিটি মানুষ নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করে রাখে, যে দেয়ালের মধ্যে কখনো কেউ প্রবেশ করতে পারে না, যে দেয়ালের ভেতরের কথা গুলো কখনো কেউ জানতে পারে না— এই অদৃশ্য দেয়ালের নামই ‘শঙ্খনীল কারাগার’।
এই উপন্যাস টি হুমায়ূন আহমেদ ফুটিয়ে তুলেছিলেন শুধুমাত্র তাঁর অসামান্য চিন্তাশক্তি ও প্রতিভার মধ্য দিয়ে, কোনরকম লেখকীয় দক্ষতা দিয়ে নয়। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ নবীন ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের এক অসামান্য একটি লেখা!
পুরো বইটা পড়া হয়ে গেলেও মাথার ভেতর দুটি লাইন ঘোরাফেরা করে, যে লাইন দুটি একদম আমাদের কথা বলে; চুপচাপ মুখ বুঁজে হাসিমুখে কাজ করে যাওয়া মানুষটার ভেতরেও যে বিশাল এক অব্যক্ত চাহিদা পরে থাকে, সেই চাহিদার কথা; ভালবাসা না পেতে পেতে মনের মধ্যে সীমাহীন ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যে হাহাকার, সেই হাহাকারের কথাই যেন বলে এই দুটো লাইন—
‘দিতে পারো একশো ফানুস এনে?
আজন্ম সলজ্জ সাধ— একদিন আকাশে কিছু ফানুস ওড়াই!’
রিভিউ: দীপক
রিভিউ: দীপক
লেখক হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার কেন্দুয়ার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তিনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হিসেবে পরিচিত। 'নন্দিত নরকে' উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথেই তিনি বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়েন। এরপর তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস 'শঙ্খনীল কারাগার' প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। এরপর তাঁর লেখনি আর থামেনি। তিনি সৃষ্টি করেছেন বাংলা উপন্যাসের জনপ্রিয় চরিত্র 'হিমু' ও 'মিসির আলি'কে। নাটক ও সিনেমা তৈরিতেও তাঁর সফলতা রয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর অসংখ্য বহুমাত্রিক সৃষ্টির জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হলোঃ বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), শিশু একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক (১৯৯৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসুদন পদক (১৯৮৭), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই-এ স্থানীয় সময় ১১:২০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হসপিটালে এই নন্দিত লেখক মৃত্যুবরণ করেন। তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়।
বাংলার লোকসাহিত্য - চতুর্থ খণ্ড
বাংলার লোকসাহিত্য - চতুর্থ খণ্ড
লেখক - আশুতোষ ভট্টাচার্য্য
আশুতোষ ভট্টাচার্য (জন্ম ১৯০৯ – মৃত্যু মার্চ ১৯ ১৯৮৪) একজন বিশিষ্ট বাংলা সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ও অধ্যাপক। জন্ম অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার ঢালুয়াতে। পিতা মুরারিমোহন ভট্টাচার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে বাংলা সাহিত্যে (১৯৩২) ও পরে সংস্কৃতে এমএ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। এরপর সাত বছর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় সহায়ক গবেষকের কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ১৯৫৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক এবং ১৯৭০ সালে বাংলা বিভাগের প্রধান হন। অবসর গ্রহণ করেন ১৯৭৮ সালে। আশুতোষ ভট্টাচার্যের গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল লোকসংস্কৃতি। এই বিষয়ে তিনি অনেক নিবন্ধও রচনা করেন। পুরুলিয়ার ছৌ নাচ তিনিই বিশ্বের সমক্ষে প্রথম তুলে ধরেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য’, ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’, ‘পুরুলিয়া থেকে আমেরিকা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। গবেষণার স্বীকৃতি রূপে ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, ১৯৬১ সালে শিশির স্মৃতি পুরস্কার পান এবং ১৯৬৯ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। এছাড়া লোকসংস্কৃতি পরিষদ, নিখিলবঙ্গ সাহিত্য-সম্মেলন ইত্যাদি বহু সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। আমেরিকা ও ইউরোপের একাধিক স্থানে লোকসংস্কৃতি বিষয়ে বক্তৃতাও দেন।
বাংলার লোকসাহিত্য - তৃতীয় খণ্ড
বাংলার লোকসাহিত্য - তৃতীয় খণ্ড
শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য্য
লেখক আশুতোষ ভট্টাচার্য্য
আশুতোষ ভট্টাচার্য (জন্ম ১৯০৯ – মৃত্যু মার্চ ১৯ ১৯৮৪) একজন বিশিষ্ট বাংলা সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ও অধ্যাপক। জন্ম অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার ঢালুয়াতে। পিতা মুরারিমোহন ভট্টাচার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে বাংলা সাহিত্যে (১৯৩২) ও পরে সংস্কৃতে এমএ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। এরপর সাত বছর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় সহায়ক গবেষকের কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ১৯৫৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক এবং ১৯৭০ সালে বাংলা বিভাগের প্রধান হন। অবসর গ্রহণ করেন ১৯৭৮ সালে। আশুতোষ ভট্টাচার্যের গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল লোকসংস্কৃতি। এই বিষয়ে তিনি অনেক নিবন্ধও রচনা করেন। পুরুলিয়ার ছৌ নাচ তিনিই বিশ্বের সমক্ষে প্রথম তুলে ধরেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য’, ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’, ‘পুরুলিয়া থেকে আমেরিকা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। গবেষণার স্বীকৃতি রূপে ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, ১৯৬১ সালে শিশির স্মৃতি পুরস্কার পান এবং ১৯৬৯ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। এছাড়া লোকসংস্কৃতি পরিষদ, নিখিলবঙ্গ সাহিত্য-সম্মেলন ইত্যাদি বহু সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। আমেরিকা ও ইউরোপের একাধিক স্থানে লোকসংস্কৃতি বিষয়ে বক্তৃতাও দেন।
বাংলার লোকসাহিত্য - দ্বিতীয় খণ্ড
বাংলার লোকসাহিত্য - দ্বিতীয় খণ্ড
শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য্য
লেখক আশুতোষ ভট্টাচার্য্য
আশুতোষ ভট্টাচার্য (জন্ম ১৯০৯ – মৃত্যু মার্চ ১৯ ১৯৮৪) একজন বিশিষ্ট বাংলা সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ও অধ্যাপক। জন্ম অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার ঢালুয়াতে। পিতা মুরারিমোহন ভট্টাচার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে বাংলা সাহিত্যে (১৯৩২) ও পরে সংস্কৃতে এমএ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। এরপর সাত বছর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় সহায়ক গবেষকের কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ১৯৫৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক এবং ১৯৭০ সালে বাংলা বিভাগের প্রধান হন। অবসর গ্রহণ করেন ১৯৭৮ সালে। আশুতোষ ভট্টাচার্যের গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল লোকসংস্কৃতি। এই বিষয়ে তিনি অনেক নিবন্ধও রচনা করেন। পুরুলিয়ার ছৌ নাচ তিনিই বিশ্বের সমক্ষে প্রথম তুলে ধরেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য’, ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’, ‘পুরুলিয়া থেকে আমেরিকা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। গবেষণার স্বীকৃতি রূপে ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, ১৯৬১ সালে শিশির স্মৃতি পুরস্কার পান এবং ১৯৬৯ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। এছাড়া লোকসংস্কৃতি পরিষদ, নিখিলবঙ্গ সাহিত্য-সম্মেলন ইত্যাদি বহু সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। আমেরিকা ও ইউরোপের একাধিক স্থানে লোকসংস্কৃতি বিষয়ে বক্তৃতাও দেন।
বাংলার লোকসাহিত্য - প্রথম খণ্ড
বাংলার লোকসাহিত্য - প্রথম খণ্ড
শ্রীআশুতোষ ভট্টাচার্য্য
লেখক আশুতোষ ভট্টাচার্য্য
আশুতোষ ভট্টাচার্য (জন্ম ১৯০৯ – মৃত্যু মার্চ ১৯ ১৯৮৪) একজন বিশিষ্ট বাংলা সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি গবেষক ও অধ্যাপক। জন্ম অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার ঢালুয়াতে। পিতা মুরারিমোহন ভট্টাচার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে বাংলা সাহিত্যে (১৯৩২) ও পরে সংস্কৃতে এমএ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত। এরপর সাত বছর আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় সহায়ক গবেষকের কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে ১৯৫৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্র অধ্যাপক এবং ১৯৭০ সালে বাংলা বিভাগের প্রধান হন। অবসর গ্রহণ করেন ১৯৭৮ সালে। আশুতোষ ভট্টাচার্যের গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল লোকসংস্কৃতি। এই বিষয়ে তিনি অনেক নিবন্ধও রচনা করেন। পুরুলিয়ার ছৌ নাচ তিনিই বিশ্বের সমক্ষে প্রথম তুলে ধরেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’, ‘বাংলার লোকসাহিত্য’, ‘বাইশ কবির মনসামঙ্গল’, ‘পুরুলিয়া থেকে আমেরিকা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। গবেষণার স্বীকৃতি রূপে ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, ১৯৬১ সালে শিশির স্মৃতি পুরস্কার পান এবং ১৯৬৯ সালে সঙ্গীত নাটক আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। এছাড়া লোকসংস্কৃতি পরিষদ, নিখিলবঙ্গ সাহিত্য-সম্মেলন ইত্যাদি বহু সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। আমেরিকা ও ইউরোপের একাধিক স্থানে লোকসংস্কৃতি বিষয়ে বক্তৃতাও দেন।
মিসির আলি অমনিবাস ১
মিসির আলি অমনিবাস ১
লেখক - হুমায়ূন আহমেদ
মিসির আলি, বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় রহস্যময় চরিত্র। মিসির আলী কাহিনীগুলো রহস্যমাত্রিক। মিসির আলির কাহিনীগুলো ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী নয়, কিংবা 'ক্রাইম ফিকশন' বা 'থ্রিলার'-এর মতো খুনি-পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া নয়, বরং মনস্তাত্ত্বিক, বিজ্ঞাননির্ভর এবং প্রচন্ড যুক্তিনির্ভর কাহিনীর বুনটে বাঁধা। বরং অনেক ক্ষেত্রে একে রহস্যগল্প বলা চলে। চারিত্রিক দিক দিয়ে মিসির আলি চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের আরেক অনবদ্য সৃষ্টি হিমু চরিত্রটির পুরোপুরি বিপরীত। তরুণ হিমু চলে প্রতি-যুক্তির (anti-logic) তাড়নায়; অপরপক্ষে বয়োজ্যেষ্ঠ মিসির আলি অনুসরণ করেন বিশুদ্ধ যুক্তি (pure logic)। এই যুক্তিই মিসির আলিকে রহস্যময় জগতের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে সাহায্য করে। সেসব কাহিনীর প্রতিফলন ঘটেছে মিসির আলি সম্পর্কিত প্রতিটি উপন্যাসে।
ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলি চরিত্রটির ধারণা প্রথম পেয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে, স্ত্রীর সাথে গাড়িতে ভ্রমণের সময়। চরিত্রটির ধারণা মাথায় চলে এলেও তিনি মিসির আলি চরিত্রের প্রথম উপন্যাস "দেবী" লিখেন এই ঘটনার অনেকদিন পর।
উপন্যাসের কাহিনী অনুসারে মিসির আলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের "মনোবিজ্ঞান" (Psychology) বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক (খন্ডকালীন)। শুধুমাত্র একজন শিক্ষক হিসেবেই নন, তাঁর অনুসারীদের কাছেও তিনি বেশ মর্যাদাবান একজন চরিত্র হিসেবে উল্লিখিত। সেজন্য উপন্যাস বা বড় গল্পে, মিসির আলিকে বোঝাতে লেখক 'তার' লেখার পরিবর্তে সম্মানসূচক 'তাঁর' শব্দটির ব্যবহার করতেন। মিসির আলির বয়স ৪০-৫০-এর মধ্যে। তাঁর মুখ লম্বাটে। সেই লম্বাটে মুখে এলোমেলো দাড়ি, লম্বা উসখো-খুসকো কাঁচা পাকা চুল। প্রথম দেখায় তাঁকে ভবঘূরে বলে মনে হতে পারে; কিছুটা আত্মভোলা। তাঁর হাসি খুব সুন্দর, শিশুসুলভ। মিসির আলির স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো।
তিনি মানুষের মন, আচরণ, স্বপ্ন এবং নানাবিধ রহস্যময় ঘটনা নিয়ে অসীম আগ্রহ রাখেন। হুমায়ুন আহমেদের নিজের ভাষ্যে—
মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা।
চরিত্রটির পরিচিতি দিতে গিয়ে হুমায়ুন আহমেদ বলছেন—
মিসির আলি একজন মানুষ, যাঁর কাছে প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলা বড় কথা, রহস্যময়তার অস্পষ্ট জগৎ যিনি স্বীকার করেন না।
মিসির আলি চরিত্রে হুমায়ুন আহমেদ, পরস্পর বিপরীতধর্মী দুটি বৈশিষ্ট্য 'যুক্তি' এবং 'আবেগ'কে স্থান দিয়েছেন।
মিসির আলি একজন ধূমপায়ী। তিনি 'ফিফটি ফাইভ' ব্র্যান্ডের সিগারেট খান। তবে তিনি প্রায়ই সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করেন। তাঁর শরীর বেশ রোগাটে আর রোগাক্রান্ত। নানারকম রোগে তাঁর শরীর জর্জরিত: লিভার বা যকৃৎ প্রায় পুরোটাই অকেজোঁ প্রায়, অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে, রক্তের উপাদানে গড়বড়, হৃৎপিণ্ড ড্রপ বিট দেয়। এজন্য কঠিন এসব রোগের পাশাপাশি সাধারণ যেকোনো রোগই তাঁকে বেশ কাহিল করে ফেলে। ফলে প্রায়ই অসম্ভব রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন।
মিসির আলি যুক্তিনির্ভর একজন মানুষ বলেই অসম সাহসিক। ভূতাশ্রিত স্থানেও রাত কাটাতে তিনি পিছপা হোন না, বরং এজন্য থাকেন যে, তাতে তিনি রহস্যময়তার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারবেন। মিসির আলির অনেকগুলো পারঙ্গমতার মধ্যে অন্যতম হলো তিনি যে কাউকে, বিশেষ করে ঠিকানাওয়ালা মানুষকে, খুব সহজে অজানা স্থানেও খুঁজে বের করতে পারেন। এজন্য তিনি টেলিফোন ডিরেক্টরি, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর, টিভি-বেতার-এর লাইসেন্স নম্বর, পুলিশ কেস রিপোর্ট, হাসপাতালের মর্গের সুরতহাল (পোস্টমোর্টেম) রিপোর্ট ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। মিসির আলি প্রকৃতির বিষ্ময়ে বিষ্মিত হলেও প্রচণ্ড যুক্তির বলে বিশ্বাস করেন প্রকৃতিতে রহস্য বলে কিছু নেই। মিসির আলি ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে একজন নাস্তিক। মিসির আলি সিরিজের প্রথম উপন্যাস "দেবী"-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি নিজেকে নাস্তিক বলে অভিহিত করেছেন। তবে কিছু জায়গায় তাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী অর্থাৎ একজন আস্তিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
মিসির আলি মূলত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ, মোটামুটি সব উপন্যাসে তাঁকে এভাবেই রূপায়িত করা হয়। কিন্তু "অন্য ভূবন" উপন্যাসে মিসির আলি বিয়ে করে ফেলেন বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু পরবর্তী উপন্যাসগুলিতে আবার তাঁকে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এপ্রসঙ্গে লেখক নিজেই স্বীকার করেন যে, "এটি বড় ধরণের ভুল" ছিলো। মিসির আলির মতো চরিত্র বিবাহিত পুরুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেই ভুল শুধরে পরবর্তি উপন্যাসগুলোতে আবার মিসির আলিকে নিঃসঙ্গ হিসেবে উপস্থাপন করেন লেখক। ফলে মিসির আলি চরিত্রটি যা দাঁড়ায়: মিসির আলি ভালোবাসার গভীর সমুদ্র হৃদয়ে লালন করেন, কিন্তু সেই ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেবার মতো কাউকেই কখনও কাছে পান না। ভালোবাসার একাকীত্বে জর্জরিত মিসির আলির নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে বিভিন্ন সময় কিশোরবয়সী কাজের লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন: "আমি এবং আমরা" উপন্যাসে "বদু" নামের একটি, ১৫-১৬ বছরের কাজের ছেলের উল্লেখ রয়েছে। 'দেবী' ও 'নিশীথিনী' গল্পে হানিফা নামে একটা কাজের মেয়ে ছিল। এরকম কাজের লোককে মিসির আলি লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেন। আবার "অন্য ভূবন" উপন্যাসে "রেবা" নামের একটি কাজের মেয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মিসির আলির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত সারমর্ম করতে হুমায়ূন আহমেদই লিখেন—মিসির আলি নিঃসঙ্গ, হৃদয়বান, তীক্ষ্ণ ধীশক্তির অধিকারী। কাহিনী অনুসারে তিনি অকৃতদার। চরিত্রটি লেখকেরও, প্রিয় চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মিসির আলি চরিত্রটি এতোটাই পাঠক জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে, অনেকেই তাঁকে রক্তমাংসের মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ প্রায়ই জিজ্ঞাসিত হন যে, মিসির আলি কি কোনো বাস্তব চরিত্রকে দেখে লেখা কিনা। এর নেতিবাচক উত্তর পেয়ে অনেকেই আবার মিসির আলি চরিত্রটির মধ্যে লেখকেরই ছায়া খুঁজে পান। এপ্রসঙ্গে স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদই উত্তর করেন—
না, মিসির আলিকে আমি দেখিনি। অনেকে মনে করেন লেখক নিজেই হয়তো মিসির আলি। তাঁদেরকে বিনীতভাবে জানাচ্ছি- আমি মিসির আলি নই। আমি যুক্তির প্রাসাদ তৈরি করতে পারি না এবং আমি কখনও মিসির আলির মতো মনে করিনা প্রকৃতিতে কোনো রহস্য নেই। আমার কাছে সব সময় প্রকৃতিকে অসীম রহস্যময় বলে মনে হয়।
কিন্তু এই অভয়বাণীসত্ত্বেয় নলিনী বাবু B.Sc উপন্যাসে লেখককেই মিসির আলীর ভূমিকায় দেখা যায়, এবং তিনি যে মিসির আলী থেকে আলাদা কিন্তু তাঁর স্রষ্টা তার স্পষ্ট উল্লেখ করেন—
আমি (লেখক) এই ভেবে আনন্দ পেলাম যে, সালেহ চৌধুরী (লেখকের সফরসঙ্গী) মিসির আলিকে উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে দেখছেন না। অতি বুদ্ধিমান মানুষও মাঝে মাঝে বাস্তব-অবাস্তব সীমারেখা মনে রাখতে পারেন না।
হুমায়ূন আহমেদের এই জনপ্রিয় চরিত্রটিকে বিটিভির পর্দায় বেশ কয়েকবার নিয়ে আসা হয়েছে। অনেক খ্যাতিমান টিভি অভিনেতা অভিনেত্রীরা মিসির আলির উপন্যাস-কেন্দ্রিক নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে অধিকাংশ নাটকে মিসির আলির চরিত্র রূপায়ণে ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যাভিনেতা আবুল হায়াত। এছাড়া প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের একবার এই চরিত্রে রূপদান করেছেন।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে, এনটিভিতে সর্বপ্রথম, মিসির আলিকে নিয়ে একটি নাটক তৈরি হয়। নাটকটি তৈরি করেছিলেন নির্মাতা অনিমেষ আইচ। নাটকটির নাম ছিলো "বৃহন্নলা", যা ছিলো, মিসির আলি-কেন্দ্রিক উপন্যাস "বৃহন্নলা"র নাট্যরূপ। নাটকটিতে মিসির আলি'র ভূমিকায় অভিনয় করেন, তরুণ অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুত। পরবর্তিতে অনিমেশ আইচ, মিসির আলির, "নিষাদ" উপন্যাসটিকে নিয়ে "নিষাদ" নামে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন, যা ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে এনটিভিতে প্রচারিত হয়েছিলো। 'নিষাদ'-এ মিসির আলির চরিত্রে অভিনয় করেন প্রখ্যাত অভিনেতা শাহরিয়ার শূভ।
মিসির আলি সংক্রান্ত উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ প্রথম পর্যায়ে আলাদা আলাদা বই আকারে বের হলেও পরবর্তিতে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা চরিত্রটির পাঠক সমাদর বিবেচনা করে তা সংকলিত আকারেও প্রকাশ করে। এরকম সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রতীক প্রকাশনা সংস্থার "মিসির আলি অমনিবাস ১" ও "মিসির আলি অমনিবাস ২"। এছাড়াও মিসির আলির সমস্ত উপন্যাস নিয়ে (মিসির আলি আনসল্ভড, "মিসির আলি, আপনি কোথায়?", "পুফি" এবং "যখন নামিবে আঁধার" ব্যতীত) অনন্যা প্রকাশনা সংস্থা মিসির আলি সমগ্র নামে একটি বই প্রকাশ করে। বইটি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে প্রকাশিত হয়। কলকাতার কাকলি প্রকাশনী দুই খণ্ডে সম্প্রতি মিশির আলি সমগ্র প্রকাশ করেছে।
মিসির আলি অমনিবাস ১
এই খণ্ডে রয়েছে
- দেবী
- নিশীথিনী
- নিষাদ
- অন্যভুবন
- বৃহন্নলা
- ভয়
- বিপদ
- অনীশ
- মিসির
- আলির অমিমাংসিত রহস্য।
লেখক হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণা মহুকুমার কেন্দুয়ার কুতুবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তিনি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হিসেবে পরিচিত। 'নন্দিত নরকে' উপন্যাস প্রকাশের সাথে সাথেই তিনি বোদ্ধা পাঠকের নজর কাড়েন। এরপর তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস 'শঙ্খনীল কারাগার' প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। এরপর তাঁর লেখনি আর থামেনি। তিনি সৃষ্টি করেছেন বাংলা উপন্যাসের জনপ্রিয় চরিত্র 'হিমু' ও 'মিসির আলি'কে। নাটক ও সিনেমা তৈরিতেও তাঁর সফলতা রয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ তাঁর অসংখ্য বহুমাত্রিক সৃষ্টির জন্য নানা পুরস্কারে ভূষিত হন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলি হলোঃ বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), শিশু একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক (১৯৯৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (শ্রেষ্ঠ কাহিনী ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ১৯৯৪, শ্রেষ্ঠ সংলাপ ১৯৯৪), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসুদন পদক (১৯৮৭), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক। মলাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০১২ সালের ১৯ জুলাই-এ স্থানীয় সময় ১১:২০ মিনিটে নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হসপিটালে এই নন্দিত লেখক মৃত্যুবরণ করেন। তাকে নুহাশ পল্লীতে দাফন করা হয়।
কবিতা সমগ্র ১
কবিতা সমগ্র ১
শামসুর রাহমান
কবি শামসুর রাহমান
শামসুর রাহমান বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে দুই বাংলায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত। শামসুর রাহমান সাংবাদিক হিসেবে ১৯৫৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন দৈনিক মর্নিং নিউজে। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। এরপর তিনি আবার ফিরে আসেন তার পুরানো কর্মস্থল দৈনিক মর্নিং নিউজে। তিনি সেখানে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নভেম্বর, ১৯৬৪ থেকে শুরু করে সরকারি দৈনিক দৈনিক পাকিস্তান এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৭ এর জানুয়ারি পর্যন্ত (স্বাধীনতা উত্তর দৈনিক বাংলা)। ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ তে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাঁকে পদত্যাগ বাধ্য করা হয়। অতঃপর তিনি অধুনা নামীয় মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিংশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। কেবল বাংলাদেশের কবি আল মাহমুদ এবং পশ্চিমবঙ্গের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিংশ শতকের শেষার্ধে তুলনীয় কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বলে ধাণা করা হয়। আধুনিক কবিতার সাথে পরিচয় ও আন্তর্জাতিক-আধুনিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ১৯৪৯-এ, এবং তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৪৯ মুদ্রিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। শামসুর রাহমান বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছন্দনাম নিয়েছেন। সে গুলো হচ্ছে: সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয় যা দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সমালোচক আবু সায়ীদ আইয়ুব। শামসুর রাহমান ২৩ অক্টোবর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন এবং ১৭ আগস্ট ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
ট্রুথ লাভ এন্ড এ লিটল ম্যালিস
খুশবন্ত সিং এর আত্মজীবনী
ট্রুথ লাভ এন্ড এ লিটল ম্যালিস
অনুবাদ - আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে খুশবন্ত সিং সুপরিচিত এবং লেখক হিসেবে অত্যন্ত সমাদৃত। তার লিখা পড়তে শুরু করলে আর থেমে থাকার উপায় থাকে না। পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় ধরে তিনি একটানা লিখে যাচ্ছেন। লেখক, সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গি বরাবর প্ররোচনামূলক ও বিতর্কিত। কিন্তু লিখা গভীর চেতনায় সমৃদ্ধ এবং আবেদনপূর্ণ। সর্বোপরি খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি সততা থেকে বিচ্যুত হননি এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, পাঠকদের কখনো বঞ্চিত করেননি। তার আত্মজীবনী আসলে তার জীবন ও কাজের উপর লিখা একটি বিবরণ। ১৯১৫ সালে বিভাজন-পূর্ব পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণকারী খুশবন্ত সিং আধুনিক ভারতের ইতিহাসের অধিকাংশ প্রধান ঘটনার প্রত্যক্ষদশী। উপমহাদেশের বিভক্তি ও স্বাধীনতা থেকে শুরু করে ভারতের জরুরি অবস্থা, স্বর্ণমন্দিরে উগ্র শিখদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশন ব্লু স্টার’ এবং তার পরিণতি দেখেছেন খুব কাছে থেকে। ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত বহু নেতার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। তিনি জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধীর মতো নেতা, সন্ত্রাসী জনাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে, মেধাবী ও কেলেংকার সৃষ্টিকারী চিত্রশিল্পী অমৃতা শেরগিল এবং উপমহাদেশ বিভক্তির সময় কসাই এ পরিণত মানুষদের সম্পর্কে লিখেছেন তার কাছে কাংক্ষিত স্বচ্ছতা ও অকপটতায় । নিজের জীবন সম্পর্কেও খুশবন্ত সিং অবিচলিত স্পষ্টতায় লিখেছেন। আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক এবং পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে পেশাগত সাফল্য ও ব্যর্থতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন । ষাট বছরের বেশি সময়ের দাম্পত্য জীবনের আনন্দ ও হতাশার কথা বলেছেন। রাজনীতি ও সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত বহু ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অজানা সত্য তুলে ধরায় সংশ্লিষ্টরা যে ক্ষুব্ধ হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং এই ক্ষুব্ধতার শিকারে পরিণত হয়েছিল তার আত্মজীবনী টুথ লাভ এন্ড এ লিটল ম্যালিস। তা না হলে এটি প্রকাশিত হতো ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে। ছয় বছর আগে লিখিত গ্রন্থটি আলোর মুখ দেখার ঠিক আগে এর একটি অংশ এক সাময়িকীতে প্রকাশ পাওয়ার পর ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ মানেক গান্ধী তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার অভিযোগ তুলে খুশবন্ত সিং ও তার প্রকাশকের বিরুদ্ধে মমলা করেন। মামলা চুড়ান্ত রায় ঘোষিত হয়ার পর গ্রন্থটি গত ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০০২ প্রকাশিত হয়।